বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৫ অপরাহ্ন
শর্করা জাতীয় খাবার এড়ানো খুবই কঠিন, সেগুলোর ভেতর চিনি আছে, আছে শ্বেতসার আর আঁশ, যা আপনি ফল, দুগ্ধ, শস্য বা সবজির ভেতরেও পেতে পারেন।
কিন্তু শর্করাকে ইদানীং অনেকটাই আলাদা করে ফেলা হচ্ছে। বিশেষ করে শরীর নিয়ন্ত্রণে রাখতে যেসব খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়, তার মধ্যে শর্করা খুব কমই অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
কিন্তু স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হলে এখনো আপনাকে খানিকটা শর্করা গ্রহণ করতেই হবে, কারণ শর্করা হচ্ছে খাদ্যের মৌলিক অংশগুলোর অন্যতম।
সমস্যা হলো, শর্করা নিয়ে এতোদিন ধরে নানা কথা শোনার পর, অনেক সময়ই আমরা শর্করা নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে যাই যে, সেটা আসলে কিভাবে আমাদের শরীরের জন্য কাজ করে।
সুতরাং এখানে শর্করা নিয়ে এমন ১০টি তথ্য তুলে ধরা হলো, যা হয়তো আপনি জানতে চাইবেন।
১. সব শর্করাই খারাপ নয়
আমাদের শরীর যেসব খাবার থেকে শক্তি সঞ্চয় করে, তার একটি হচ্ছে শর্করা জাতীয় খাবার। যার মধ্যে রয়েছে স্টার্চ বা শ্বেতসার, চিনি এবং আঁশ।
আলু, আটা, চাল ও পাস্তার মধ্যে অনেক শ্বেতসার জাতীয় শর্করা রয়েছে।
কোমল পানীয়, মিষ্টি, প্রক্রিয়াজাত খাবারের ভেতর রয়েছে চিনি।
শ্বেতসার এবং চিনি, উভয়েই আপনার শরীরের ভেতর চিনি গ্লুকোজে পরিণত হয় আর শক্তি উৎপাদন করে অথবা চর্বিতে পরিণত হয়।
তবে আরেকটি শর্করা রয়েছে, যাকে বলা হয় পথ্যজাতীয় আঁশ খাবার।
ফলমূল এবং সবজির ভেতর আঁশ রয়েছে। এ ধরণের শর্করা আস্তে আস্তে শক্তি নির্গত করে, যা আমাদের পাকস্থলীর জন্য খুবই ভালো এবং শেষপর্যন্ত সেটি শরীরের ভেতর গিয়ে চর্বিতে পরিণত হয় না।
২. কতটা শর্করা আমাদের গ্রহণ করা উচিত
কতটুকু শর্করা আমাদের খাওয়া উচিত- এটা পরিমাপ করার জন্য দ্রুত ও সহজ একটি পরীক্ষা রয়েছে।
একটি সাধারণ বিস্কুট চাবাতে শুরু করুন, যতক্ষণ না আপনি বুঝতে পারছেন যে, সেটির স্বাদ পাল্টে যাচ্ছে- সাধারণত এটা খানিকটা মিষ্টি লাগতে শুরু করে, কিন্তু আপনি হয়তো অন্য স্বাদগুলোও টের পাবেন।
যদি এই স্বাদ পরিবর্তনের ঘটনাটি ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে, তাহলে পরিমিত পরিমাণেই শর্করা গ্রহণ করছেন। যদি ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে, তাহলে খুবই ভালো।
কিন্তু ৩০ সেকেন্ডের পরেও যদি বিস্কুটের স্বাদের কোন পরিবর্তন টের না পান, তাহলে আপনার আরো কম শর্করাজাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। কারণ আপনার শরীর ঠিকভাবে শর্করার প্রক্রিয়া করতে পারছে না। এটা হয়তো আপনার ওজন বৃদ্ধি এবং অন্যসব শারীরিক সমস্যার কারণ হতে পারে।
এই পরীক্ষার নকশা করেছেন ড. শ্যারন মোলেম।
আমাদের জিহ্বায় এমন কিছু উপাদান আছে যা বড় শ্বেতসারগুলোকে ক্ষুদ্র চিনিতে বা গ্লুকোজে রূপান্তরিত করে। এ কারণেই বিস্কুটটি একসময় মিষ্টি লাগতে শুরু করে। দ্রুত বিস্কুট মিষ্টি লাগতে শুরু করা মানে, আপনার শরীরে শর্করা কম থাকার ফলে দ্রুত এনজাইম তৈরি হচ্ছে।
৩. খারাপ শর্করাও ভালো শর্করায় পরিণত হতে পারে
বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, রান্না করা এবং ঠাণ্ডা করার ফলে খারাপ শর্করা অনেক সময় ভালো শর্করায় পরিণত হয়ে যায়।
খারাপ শর্করা সহজেই গলে গিয়ে চিনিতে পরিণত হয় এবং দ্রুত শরীরের সাথে মিশে যায়, যা ওজন বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু ভালো শর্করা মিশে যায় না। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে সেটি পাকস্থলীতে জমা হয়, যা দেখে আনন্দিত হয় সেখানকার ব্যাকটেরিয়া।
পাস্তা, ভাত আর পটেটো পুনরায় গরম করে খাওয়া ভালো। বিশেষ করে মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করলে সেটি প্রতিরোধী শ্বেতসার বাড়িয়ে দেয়। তবে সেগুলো অনেক গরম করতে হবে।
৪. পাউরুটি খাওয়া ততটা খারাপ না
পাউরুটি খাওয়া খারাপ না। তবে আরো ভালো হবে যদি সাদা রঙের পাউরুটির বদলে কালচে ধরণের রুটি খেতে শুরু করেন।
সাধারণত যেসব পাউরুটি তৈরি করা হয়, সেগুলো সহজেই হজম হয়ে যায়। ফলে শরীরে গ্লুকোজ হিসাবে জমা হওয়ার বদলে আগেই অন্যান্য অংশে মিশে যায়।
তবে পূর্ণ গমের তৈরি পাউরুটি বা রুটিতে প্রতিরোধী শ্বেতসার থাকে, যার ফলে আপনার শরীরের অনেক অন্ত্রের ভেতর দিয়ে সেটি যাতায়াত করে।
পাউরুটি কেনার সময় চিনি পরিমাণটা দেখে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পূর্ণ গমের অনেক পাউরুটিতে স্বাদ বাড়ানোর জন্য চিনি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
৫. ফ্রিজ থেকে বের করে সরাসরি টোস্ট করে খাওয়া
সবচেয়ে ভালো হয় পাউরুটি যদি ফ্রিজ থেকে বের করে সরাসরি টোস্ট করে খাওয়া হয়। কারণ, এটা রান্না ও ঠাণ্ডা করার পদ্ধতিটি অনুসরণ করে। ঠাণ্ডা করার কারণে সেই রুটিতে প্রতিরোধী শ্বেতসারের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা ওই রুটি থেকে কম শর্করা তৈরি করে। এটি আপনার হজমের জন্যও অনেক উপকারী হয়ে ওঠে।
৬. খারাপ শর্করাকে ভালো শর্করা বানিয়ে পেটের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমিয়ে আনুন
যেসব শ্বেতসার আমরা খেয়ে থাকি, তার প্রায় ৯৫ শতাংশই সহজে হজম হয়ে যায়। কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরা জানেন, এর মধ্যে ছোট একটি ভাগ আছে- যাকে বলা হয় প্রতিরোধী শ্বেতসার-যেটি পেটের ভেতরে গিয়ে ব্যাকটেরিয়ার খাবারে পরিণত হয়।
এটি এমন রাসায়নিক তৈরি করে, যা পেটের ক্যান্সার প্রতিরোধে অনেক সহায়তা করে। শুধুমাত্র খারাপ শর্করাকে ভালো শর্করায় রূপান্তরিত করে আপনি বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আরো ত্রিশ শতাংশ বাড়িয়ে দিতে পারেন।
৭. পরিশোধিত শর্করা ডায়াবেটিস রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে
সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসকরা দেখতে পেয়েছেন, রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে অনেক ডায়াবেটিক রোগী ইনসুলিনের কার্যকারিতা হারাচ্ছেন।
২০১৭ সালের জাতীয় ডায়াবেটিস পরিসংখ্যানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে এখন ৩ কোটি ৩০ লাখ ডায়াবেটিক রোগী আছে, অর্থাৎ প্রতি ১০জনে ১ জনের এই রোগটি আছে।
এদের মধ্যে ৯০ শতাংশের টাইপ- টু ডায়াবেটিস, যাদের বেশিরভাগের অতিরিক্ত ওজন রয়েছে।
ডায়াবেটিককে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয়, কারণ অনেক মানুষের এই রোগের কোন লক্ষণ থাকেনা। অনেক সময় দীর্ঘদিন ধরে অশনাক্ত থাকে অথবা এমন সময় ধরা পড়ে, যখন সেটি খুব খারাপ কোন পর্যায়ে চলে গেছে।
এজন্য অনেক চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানী খারাপ খাবারকে দায়ী করে- যেমন অতিরিক্ত পরিমাণে শর্করাযুক্ত খাবার খাওয়া, যা টাইপ টু ডায়াবেটিস বাড়িয়ে দেয়। বরং স্বাস্থ্যকর এবং সঠিক খাবার খেয়ে মানুষজন তাদের ডায়াবেটিক রোগটি অনেকাংশে ঠেকাতে পারে।
৮. কম শর্করাযুক্ত খাবার ডায়াবেটিস-২ প্রতিরোধ করতে পারে
সাধারণ নিয়ম হলো, আপনার প্লেটের খাবারের রঙের দিকে তাকান। বাদামী এবং সাদা খাবার বাদ দিন, তবে সবুজ খাবার বাড়িয়ে দিন।
গবেষণা বলছে, খারাপ শর্করা দূর করতে পারলে রক্তে গ্লুকোজের গড় পরিমাণ অনেক কমিয়ে আনতে পারে। রক্তে বেশি চিনি থাকার পরিমাণ হলো আপনার ডায়াবেটিস ঝুঁকির পরিমাণও অনেক বেড়ে যাওয়া।
৯. খারাপ শর্করা সন্তান জন্মদানের ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে
গবেষক গ্রেস ডজডেল নারী ও পুরুষের ওপর একটি গবেষণা চালিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন, সন্তান জন্মদানে অক্ষমতার পেছনে আসলে ঠিক কী কাজ করে?
তিনি বলছেন, নতুন একজন মানুষকে পৃথিবীতে আনার বিষয়টি অনেক শক্তির একটি প্রক্রিয়া, নতুন একটি মানুষের জন্ম হয়, ডিম্বাণু ও ভ্রূণের নিষিক্তর প্রয়োজন হয়, আর এসব কিছুর পেছনে দরকার হয় ভালো শক্তি।
আপনি যদি খারাপ ধরণের খাবার খেয়ে থাকেন, তাহলে হয়তো সন্তান জন্ম দেয়া আপনার জন্য অনেক কঠিন হয়ে উঠবে।
যখন কোন যুগল সন্তান নিতে চান, ডজডেলের পরামর্শ হলো, কম শর্করাযুক্ত খাবার খাওয়া। নারীদের পুরো গর্ভধারণের সময় স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও এটি সহায়তা করে।
১০. খারাপ শর্করা হয়তো আপনার সন্তানদের মধ্যেও ছড়িয়ে যেতে পারে
জীন বিজ্ঞানী এবং জীব বিজ্ঞানীদের বেশ কয়েকটি গবেষণা বলছে, খারাপ খাবারের কারণে কারো জিনের গঠন পাল্টে যেতে বা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, বিশেষ করে পুরুষদের ক্ষেত্রে এটি বেশি ঘটে।
সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে আলোচনায় সাধারণত মায়ের স্বাস্থ্য নিয়েই কথা বলা হয়, কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত মোটা মানুষদের অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের কারণে তাদের জিনের ক্ষতি হচ্ছে।
অর্থাৎ সন্তান নেয়ার আগে তাদের জীবনযাপনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাদের জিনের পরিবর্তন ভ্রণের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে যেতে পারে। ফলে তাদের সন্তান কোনো রোগ নিয়ে জন্ম বা ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়তে পারে।